Skip to main content

পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনা তত্ত্ব: রাজনীতির কৌশল মাত্র:

পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনা তত্ত্ব: রাজনীতির কৌশল মাত্র: 

ছোট থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বঞ্চনার তত্ত্ব শুনে বড় হয়েছি,  আমাদের শাসক দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতারা টলিপাড়ার ভাড়া করা এবং পেছনের দরজা দিয়ে চাকরি পাওয়া শিক্ষক সমাজের একাংশকে বুদ্ধিজীবি সাজিয়ে আপামর বাঙালি জনসাধারণের মনে এই বঞ্চনার তত্ত্ব বপন  করতে সফল হয়েছিলেন। এই সমস্ত মেরুদণ্ডহীন এবং ধান্দাবাজ বুদ্ধিজীবির দল নিজেদের পকেট ভরানোর জন্য একসময় জ্যোতিবাবুর পা চেটেছেন, তারপরে বুদ্ধবাবু এবং যখন বাম পতনের শব্দের তীব্রতা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন,  ঠিক সেই সময়েই গিরগিটির মত রং বদল করে “পরিবর্তন চাই” হোর্ডিং ফেলে তৃণজিবিতে পরিণত হয়েছিলেন। লেনিন কিংবা স্ট্যালিন বেঁচে থাকলে  পশ্চিমবঙ্গের এই সকল বুদ্ধিজীবীদের চরণ স্পর্শ করে স্বীকার করতে বাধ্য হতেন যে বিপ্লব আসন্ন।

ভয়ঙ্কর সাইক্লোন আম্ফানের পরেই,  কতিপয় বুদ্ধিজীবী আরো একবার বাঙালি ভাবাবেগে সুড়সুড়ি দিয়ে বঞ্চনা তত্ত্ব সামনে নিয়ে এলেন, ইংরেজি এবং হিন্দি  সংবাদ মাধ্যমগুলি  আম্ফানের তান্ডব নিয়ে সেভাবে কোন খবর দেখায়নি বলে কার্যত বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন। পাড়ার ক্রিকেট খেলায় হেরে গেলে  একদল যেরকম বলে ব্যাট-উইকেট রেখে দে, কালকে তোদের দেখে নেব, ঠিক সেইভাবেই বলে উঠলেন জাতীয় সংগীত রেখেদে আমরা নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াব। আবেগপ্রবণ  সাধারণ বাঙালি  তাই দেখে উত্তেজিত হয়ে  মরুঝড় ভুলে গিয়ে শচীন কে  লং-অনের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। সুযোগ বুঝে বঞ্চনার আগুনে ঘি ঢালার কাজে নেমে পড়লেন মেহনতী মানুষের দল। মোদির আসতে কেন চল্লিশ ঘন্টা সময় লাগল বা  হিসেব করে বুঝিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হল এক হাজার কোটি বড্ড কম। আমরা একা ঘুরে দাঁড়াবেই, এই মনোভাব দেখাতে গিয়ে লেজেগোবরে হয়ে যাওয়ার পরে, সার্জিক্যাল স্ট্রাইকে সেনার সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলা মানুষটিও অসহায় ভাবে তিনদিন পরে সেনাবাহিনীর সাহায্য  চাইলেন। এ যেন এক অভূতপূর্ব সময়, সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে  সমস্ত বাঙালি এককভাবে লড়ছে। স্বয়ং মারাদোনা এই লড়াই প্রত্যক্ষ করতে পারলে বলতেন ছিয়াশির বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধেআমার গোলটা সর্বকালের সেরা গোল নয়, সেরা গোলটা করল আম্ফানের পরে বাঙালি। কিন্তু আমাদের প্রতিপক্ষ কে ? মোদী-শাহ তো আমাদের দলে,  তাহলে ? উত্তরটা হলো খুবই  ভয়ঙ্কর, আমাদের প্রতিপক্ষ ভারতবর্ষ,  অবাক হবেন না, ঠিকই শুনলেন।

প্রথমেই বলে রাখা ভাল, করোনা মহামারীর মধ্যেও এই ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত পূর্বাভাস থেকে শুরু করে তার তাণ্ডবলীলা সবকিছুই প্রত্যেকটি হিন্দি এবং ইংরেজি সংবাদ মাধ্যমে দেখানো হয়েছে,  তাই সংবাদ মাধ্যমের দিকে আঙ্গুল তোলা যুক্তিহীন। যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো মেনে, প্রধানমন্ত্রী নিজে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কে পাশে বসিয়ে এক হাজার কোটি টাকার তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা করেছেন এবং এই আশ্বাস দিয়েছেন কেন্দ্রীয় টিম রাজ্য সরকারের সাথে ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত পর্যালোচনা করার পর যা সাহায্যের দরকার তা কেন্দ্রীয় সরকার করবে। এই ঝড়ে যে সমস্ত পরিবার তাদের স্বজন হারিয়েছেন তাদের জন্যেও আর্থিক সহায়তা প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করে গেছেন। এর আগে আমরা বিভিন্ন বিষয়ে দেখেছি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন রাজ্য সরকারের সাথে কথা না বলে কেন্দ্রীয় সরকার কোনভাবেই রাজ্যের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে না, ঠিক সেই কারণেই রাজ্য সরকারের অনুরোধ না পাওয়া পর্যন্ত ভারতীয় সেনা পশ্চিমবঙ্গে বিপর্যয় মোকাবিলায় আসতে পারেনি। রাজনৈতিক পরিবৃত্তের বাইরে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের সাধ্যমত এগিয়ে এসেছে,  বিদেশে বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলা এবং উড়িষ্যার দুর্যোগ পাশে থাকার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং প্রত্যাশামতোই ভারতবর্ষের প্রতিটি প্রান্তের মানুষ তাদের সাধ্যমত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন.  কলকাতার কথা বাদ দিলাম, দুই চব্বিশ পরগনা  সহ বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলের মানুষের মাথায় ছাদ নেই, পানীয় জল নেই,  কোন বস্ত্র নেই কিন্তু সেই সমস্ত কথা না ভেবে হঠাৎ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সুড়সুড়ি দেওয়া শুরু হল কেন ?

পশ্চিমবঙ্গের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে খুব সহজেই বুঝতে পারা যায় সত্তরের দশকের শেষ থেকে এই  অপচেষ্টা চলছে সমান তালে,  তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর অবশ্যই লক্ষ্য পূরণ হয়েছে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির শুরু থেকে শেষ অব্দি শুধুমাত্র সর্বনাশ হয়েছে। ১৯৮৫ সালে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীজীর আমলে গরিব মানুষদের জন্য বাড়ি  তৈরীর উদ্দেশ্যে শুরু হয় “ইন্দিরা আবাস যোজনা”। ২০১৫ সাল থেকে এই প্রকল্পের নাম হয়েছে “প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা” এবং সেই সঙ্গে প্রতি বাড়িতে শৌচাগার তৈরির জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে অতিরিক্ত কুড়ি হাজার টাকা। ১৯৮৫ সাল থেকে আজ অব্দি প্রায়  আড়াই থেকে তিন কোটি বাড়ি তৈরি করা হয়েছে সমগ্র ভারতবর্ষে। পশ্চিমবঙ্গের সরকার কেন্দ্র বিরোধিতা করে এই প্রকল্পের কতটা ফায়দা তুলতে পেরেছে ? যদিও বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ সরকার “গীতাঞ্জলি” বা  “আমার ঠিকানা” নামক কিছু গৃহ নির্মাণ প্রকল্প  চালু করেছে কিন্তু তাতে কি প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার টাকা ব্যবহার করা হয় ? যদি না হয়ে থাকে তাহলে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রকল্পের টাকা আমরা কিভাবে ব্যবহার করেছি, সেই বিষয়ে বিস্তর আলোচনা হওয়া প্রয়োজন। কেন্দ্র বিরোধিতা করে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির লাভ হচ্ছে কিন্তু আমরা সাধারণ মানুষ কি পাচ্ছি?  সারা ভারতের মানুষ যখন আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত হয়ে ৫ লাখ টাকা অব্দি স্বাস্থ্যবীমা পাচ্ছেন তখন আমরা সেই প্রকল্প থেকে বঞ্চিত কেন? প্রকৃতির তান্ডব কোন সরকারের পক্ষেই আটকানো সম্ভব নয় কিন্তু পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে আজ হয়তো আমাদের এতটা অসহায় অবস্থা হতনা।আমাদের পাশের রাজ্য ওড়িশা প্রতিবছরই বেশ কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করে, কিন্তু তাদের পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা আমাদের থেকে হয়তো কিছুটা ভালো বলেই তাদের এতো করুণ পরিস্থিতি হয় না।

বঞ্চনা তত্ত্বের প্রবর্তকগন রবি ঠাকুরের জাতীয় সংগীত কে স্মরণ করলেও, সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম সহজে স্মরণ করেন না। স্বামীজি থেকে নেতাজি বা রাসবিহারী বসু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভারতবর্ষকে মাতৃরূপে প্রণাম করে গেছিলেন।  ব্রিটিশ ভারতে ফাসিঁকাঠে যত জন স্বাধীনতা সংগ্রামী বলিদান দিয়েছেন তার সিংহভাগ বাঙালি  এবং তারা প্রত্যেকেই ভারতবর্ষের জন্য  আত্মত্যাগ করেছেন। বর্তমান বাঙালির দুর্ভাগ্য এটাই, যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক ফায়দা তোলার স্বার্থে আমাদের ইতিহাস বিভিন্নভাবে বিকৃত করে ভুলিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টা চলছে। দেশভাগের যন্ত্রণা অবিভক্ত বাংলা এবং পাঞ্জাবের মানুষ যেভাবে প্রত্যক্ষ করেছিল তা অন্য প্রদেশকে  করতে হয়নি কিন্তু বর্তমান পাঞ্জাব তা মনে রাখলেও বাঙালিরা ”গ্রেটার কলকাতা কিলিং”  ভুলে গেছে। তাই অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা চলে বাঙালি একটি আত্মঘাতী জাতি।

সবশেষে বলে রাখা ভালো  বর্তমানেএই বঞ্চনা তত্ত্বের প্রবর্তকদের প্রকাশ্যে কোন রাজনৈতিক দল সমর্থন না করলেও, এর পেছনে লুকিয়ে আছে জটিল ভোটব্যাঙ্কের খেলা। যদিও বাঙালি সহজেই সবকিছু ভুলে যায়, ঠিক যেভাবে আমরা ভুলেগেছি মরিচঝাঁপি, বিজন সেতু বা সাঁইবাড়ির মত গণহত্যা, ঠিক সেই ভাবেই আমরা ভুলে যাব করোনা বা আম্ফানের সময় সমস্ত বিরোধী নেতাকে কার্যত বোতল বন্দি করে রেখে রাজনীতি না করার একান্ত অনুরোধটা। বাংলার সাধারন মানুষকে বুঝতে হবে স্বাধীনতার প্রায়  ৭৩ বছর পরে পশ্চিমবাংলার সামনে এক সুবর্ণ সুযোগ এই রাজনৈতিক  খেলাকে শেষ করে দেওয়ার। আশা করব এই কথাগুলো লেখার জন্য আমাকে কেউ “পরবাসী” বলে আক্রমণ করবে না, আমি অত্যন্ত সাধারণ একজন প্রবাসী ভারতীয়, এবং আমার বাক্ স্বাধীনতা আমার গণতান্ত্রিক অধিকার।


Comments

Popular posts from this blog

কমিউনিজম: ভারত তথা হিন্দু বিরোধী এক সন্ত্রাসী শক্তি

       দীর্ঘ সময়ে রাজনৈতিক অপশাসনের ফলে আমাদের রাজ্যে মানুষের মনে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মিথ্যা আস্ফালন রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে। পৃথিবীর বুকে সব থেকে বেশি গণহত্যাকারী শাসকদেরকে সাম্যবাদের জনক হিসেবে মানুষের সামনে   সুপরিকল্পিত মিথ্যাচারের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছে। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের বুকে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ফায়দা তুলে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালানো হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভোটাধিকারের মাধ্যমে এই একনায়কতান্ত্রিক শাসক দের রাজনৈতিকভাবে প্রায় শেষ করে দিয়েছে কিন্তু এরপরেও তারা তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুশোচনা তো দূরের কথা উল্টো সেই একইভাবে তারা আজও মানুষের সামনে সমভাবে মিথ্যা কথা বলে চলেছে। কোন তথ্যের উপর ভিত্তি করে নয় শুধুমাত্র মিথ্যা আস্ফালন এবং ব্যক্তি আক্রমণের উপর ভিত্তি করে বারংবার তারা আমাদের সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানছে। শুধুমাত্র হিন্দু ধর্ম নয় আমাদের   স্বাধীনতা সংগ্রামীদের   নিয়েও তারা ক্রমাগত ভুল তথ্য পরিবেশন করে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চাইছে। লক্ষ্য তাদের একটা,   বাঙালি হিন্দুর অস্তিত্বকে শেষ করে দেওয়া। তাই ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে কিছু সত্যি

COVID-19 augments the necessity to rebuild India’s research infrastructure to become self-reliant

COVID-19 augments the necessity to rebuild India’s research infrastructure to become self-reliant     It is very rare to see our politicians discuss about scientific research in public – well, this pandemic period has clearly made them do so. Recently, many eminent politicians rightly said that we have not invested enough in our health infrastructure and medical research in last 70 years and raised a very important question, why India depends on other countries for vaccine instead of being self-reliant? Our Honorable Prime Minister Narendra Modi Ji focused on five key components- Intent, Inclusion, Investment, Infrastructure, and Innovation to promote self-reliance during his address for Confederation of Indian Industry’s on its 125 th  anniversary. In today’s world, self-reliance can only come through Scientific and technological empowerment. As we have some fundamental problems in our research infrastructure, I would like to address those issues to our Prime Minister. Firstly